কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির অশ্বথামার মৃত্যু নিয়ে গুরু দ্রোনাচার্যকে একটি মিথ্যা কথা বলেছিলো। ছোট্ট সেই মিথ্যা কথাটি হাজার হাজার বছর ধরে অনেক সত্যকে প্রশ্নে মুখে ফেলেছে। এ রকম ছোট একটি বিষয় আমার নজরে এসেছে। কয়েক বছর ধরে এটা দেখছি।

বিশেষ করে রমজান মাস আসলে বেশি দেখি। এটা হলো রোজার শারীরিক উপকারিতা। রোজা রাখলে শরীরের কী কী উপকার হবে তার ফিরিস্তি, অটোফেজি ইত্যাদি। এগুলোর মূল কথা বিজ্ঞানের ফিতা দিয়ে রোজার গুণাগুণ পরিমাপ করা হচ্ছে। আমার খুব সহজ একটা প্রশ্নটা আছে। ধর্মকে কেন বিজ্ঞানের বাটখারায় পরিমাপ করতে হবে?

এ প্রশ্নের যৌক্তিকতা বোঝাতে তর্কের খাতিরে আরও দুটো প্রশ্ন করতে হবে- প্রথম প্রশ্ন- যদি বিজ্ঞানের মতে রোজার উপকারিতা না থাকতো, তবে কি আমরা রোজা করতাম না? দ্বিতীয় প্রশ্ন করার আগে ছোট আরেকটি ঘটনা বলতে হবে। ১৩শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা কিন্তু পৃথিবীকে স্থির রেখে সূর্যকে ঘোরাতো। সেটা ছিল টলেমির জিওসেন্ট্রিক তত্ত্ব। ১৫৪২/৩ সালে পোল্যান্ডের কোপারনিকাস সেটাকে ভুল বললো।

সে নতুন করে হেলিওসেন্ট্রিক তত্ত্ব দিল। সহজ ভাষায়, সূর্য স্থির আছে, পৃথিবী ঘুরছে। ভাগ্য ভালো যে, তাঁর বইটার প্রিন্ট যে দিন শেষ হয়, সে দিন তিনি মারা যান। তাই খ্রিস্টান পাদ্রীরা তাঁকে সাইজ করতে পারেনি। তবে ধরা খেয়ে যায় আরেক ইটালিয়ান দার্শনিক ব্রুনো। সে কোপারনিকাসকে সমর্থন করেছিল। ফলে তাঁর ভাগ্যে জুটেছিল নির্মম মৃত্যু।

১৬০০ সালে ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হলো। এর পরেও সূর্য ও পৃথিবীর ঘোরাঘুরি শেষ হয়নি। কখনো এটা ঘুরছে তো কখনও ওটা ঘুরছে, মাঝেমধ্যে দুটোই ঘুরছে। তার মানে হলো, বিজ্ঞান বদলায়, সময়ে অসময়ে বদলায়। তর্কের খাতিরে এবার সেই দ্বিতীয় প্রশ্ন- যদি কাল (ধরেন আরও ৫০-১০০ বছর) আবার বিজ্ঞান বলে যে, অটোফেজি শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তাহলে কি রোজা বিজ্ঞানের গ্যাঁড়াকলে পড়বে না?

আজতে যারা অটোফেজি নিয়ে মাতামাতি করছে, তখন তারা কোথায় গিয়ে মুখ লুকাবে? আসলে এ সব বলার উদ্দেশ্য হলো, ধর্ম ও বিজ্ঞান যে যার মতো চলবে। ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানে ধর্ম খুঁজলে না থাকে ধর্ম, না পাওয়া যায় বিজ্ঞান। ধর্মে টিকে থাকে বিশ্বাসে। এ বিশ্বাস চিরন্তন। এ বিশ্বাস যুগের পর যুগ ধর্মকে আগলে রেখেছে। আর বিজ্ঞান তথ্য, উপাত্ত, প্রমাণ দিয়ে একটি যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, তবে তা কখনোই চিরন্তন নয়। এ সিদ্ধান্ত বদলায়, সময়ে-অসময়ে বদলায়, বহুবার বদলায়।

শেষ করার আগে আরও কয়েকটি কথা বলি। ইসলামের বিধানে রোজা রাখার আবশ্যকতা আছে, রোজা রাখতে হবে। হিন্দুশাস্ত্রে উপোস করার বিধান আছে, উপোস করতে হবে। এটাই ধর্ম। ধার্মিকেরা ধর্ম পালন করবে- রোজা রাখবে, উপোস করবে। বিজ্ঞানে ভালো বললেও সেটা করবে, ভালো না বললেও সেটা করবে। মৃত্যুর পরে আপনার ধর্মের প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু কোনোভাবেই সেখানে বিজ্ঞান লাগবে না।

আজকে যদি শারীরিক গুণাগুণ দিয়ে রোজাকে জনপ্রিয় করতে হয়, তবে কালকে কুরবানি, পরশু খতনাকেও বিজ্ঞানের বাটখাড়ায় ফেলতে হবে। এটাই অধার্মিকদের ট্রিকস, ধর্মের সব কিছুকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানো। ধার্মিকেরা নিজেদের অজান্তে বার বার সে ফাঁদে ধরা দিচ্ছে।

রোজার বিজ্ঞানসম্মত প্ররোচনার ফলে আজকাল আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করছি। লোকজন এখন রোজা রাখছে শরীরের মেদ-ভুড়ি কমানোর জন্য। শরীর ফিট রাখার জন্য। ধর্মীয় বিধান পালন সেখানে মূখ্য নয়। এদের চেনার সহজ উপায়- এরা রোজা রাখে, নামাজ পড়ে না।

(লেখক -ইলিয়াস হুসাইন শ্রাবণ–রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)

 

কলমকথা/ বিথী